টুকুনগল্প

সেপাই

বাদশা মিয়া টুলে বসে ঝিমায়। এক গাড়ি এসে হর্ন মারলে তার বেবাক ঝিমানি উচট খেয়ে ডিগবাজি মারে। সটান হয়ে সে গেট খুলে দেয়। সালাম ঠুকে। গাড়ির ড্রাইভার পেছনে এক ময়ূরপঙ্খি রাজকন্যা নিয়ে মিষ্টি ওম ছেড়ে উড়ে চলে। ফের টুলে গিয়ে ঝিমানির প্রস্তুতি নেয় বাদশা মিয়া। খাউজায় মুখ নাক গলা। হা করে হাই তুলতে গিয়ে ওপরের আকাশে চোখ পড়ে। গাছের ডালে তার পাতায় কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ছিদ্রে পূর্ণিমার আলো জোনাক জোনাক খেলে। বাদশা মিয়া এবার ঘাড় সোজা করে হাতের গিড়া ফুটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শব্দ বেরোয় না। তার ডিউটি সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত। আগে রাতে অন্য এক দারোয়ান পাহাড়া দিতো। বছর দুই আগে কারা যেন সেই দারোয়ানকে মেরে মহল্লায় ঢুকতে চেয়েছিল। এ পাড়ায় আমীর থাকে। তখন থেকে মহানগর কমিটি কয়েকটা ক্যাডারকে রাতে পাহাড়ায় বসায়। চ্যাংড়া পোলাপান। কিন্তু হারামীর একশেষ। অস্ত্র সাথে রাখে। আর মুখের ভাষা যাচ্ছেতাই। বাদশারে ডাকে বাদাইম্যা। বাদশা তখন মনে মনে খিস্তি করে। এখনো তিন ঘণ্টা বাকি। মহল্লার দ্বিতীয় বাড়িটার নিচতলার সিঁড়ির চিপায় বাদশা মিয়ার ঘরবসতি। একটা চৌকি। তেল চিটচিটে বালিশ আর চাদরে ধুলো পড়ে পড়ে এতো মলিন, ভালো করে তাকালে বোঝাও যায় না এককালে এদের রঙ কি ছিল। চৌকির তলে ট্রাঙ্কে তার নিজের সংসার, মাঠ, উঠোন, এক চিলতে আকাশ দীর্ঘ ঘুমে মগ্ন। বাদশা মিয়ার রান্নাও চলে সেই চিপার এক ছোট্ট কোনায়। ভাত। ডাল। কিংবা আলুসেদ্ধ। মাঝে মধ্যে একটা পোড়া শুকনা মরিচ। একই খাবার গোগ্রাসে গিলে খায় প্রতিদিন। রাতে শোয়ামাত্র বউ-বাচ্চার কথা মাথায় আসতে না আসতেই বেহুঁশ ঘুমে ঢলে পড়ে।

কলোনির মোড়ে আলীর চায়ের দোকান। মাথায় কিস্তি টুপি পড়ে সারাটা দিন বসে বসে পান চিবায়। পানের পিক গালের মধ্যে রেখে গার্গল গার্গল গলায় অদ্ভুতভাবে কথা বলে। বামহাতের তালুর খানিক ওপরের একটা বিশ্রী ঘা চুলকায় চা বানানোর অবসরে। কথা বলতে গেলে মুখ থেকে লাল পিকের কোন সূক্ষ্ণ ফোঁটা ঠোঁট গলিয়ে তার খড়খড়ে দাঁড়িতে ঝুলে ঝুলে ডাইভ মারার প্রস্তুতি সারে। আলীর দোকানে চা খেতে ইচ্ছে করে না বাদশা মিয়ার। কিন্তু এই রাতে ঘুমে ঠেকাতে সেখানে যাওয়া ছাড়া গতি নাই। দোকানের সামনে দাঁড়ানো মাত্র ‘দিতাছি’ বলে জাবর কাটতে থাকে আলী। সামনে রিকশার বিশাল লাইন পড়ে গেছে। এক দম্পত্তি হুড ফেলে আশেপাশের এলাকাকে তাদের সেন্টের গন্ধে কাবু করে রিকশায় বসে উসখুস করে। চায়ে চুমুক দিয়ে বাদশা মিয়া পানের পিকের ডুবসাঁতারের ঘ্রাণ শোঁকে। রিকশাগুলো এক চুল ও সরে না। রিকশার মেয়েটার সাদা উন্মুক্ত বাহু ভরা চাঁদের আলোয় সোডিয়ামের হলদে আভায় এক মহাজাগতিক আমেজে বাদশা মিয়ায় চোখেমুখে ঝাপটা মারে। চা শেষ করে কাপ রেখে রিকশার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় বাদশা মিয়ার শীতার্ত চোখ হালকা বড় হয়। মোড়ের একটু বামে মহল্লার ডাস্টবিনের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। বাদামি ময়লা প্যান্টের পোস্টাপিস খুলে। অপরিষ্কার সোঁদা গন্ধের সাথে পেশাবের মৃদুমন্দ শব্দ মিশে একাকার হয়। পরে ধীরে আস্তে সে টুলে গিয়ে ফেরে।

টুলে গিয়ে বসামাত্র নানান কিছু মাথায় এদিক ওদিক থেকে হানা দেয়। মেয়ের কথা। লিকলিকে কালো বউটার কথা। ভাঙা টিনের চালা বাড়ির চেহারা। আম্মার কবর। এঁটোকাদা রাস্তা। গ্রামের বাজারের উত্তরে ইটের ভাটা। চিমনির ধোঁয়া। হাটে লাল মিয়ার চায়ের দোকানে ভিসিপিতে ছাড়া শ্রীদেবীর ছবি। সব মগজে কি ঘিলুতে এক সাথে ঢোকার পাঁয়তারা করে। ফুৎকারে সব উড়িয়ে দিতে বাদশা মিয়া একটা বিড়িতে আগুন ধরায়। একদলা ধোঁয়া ছাড়তেই একটা উড়ন্ত মশার পথে টাইফুন ওঠে। কিঞ্চিৎ ভড়কে গিয়ে মশাটা পাশের শুন্যতায় সরে চলে যায়। পেটে হালকা খিদে চাগাড় দেয়। রাতের খাবারটা নিয়ে আসা দরকার। গেট গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে কোন গাড়ি এদিকে আসে কিনা। রিকশার লম্বা লাইন আর নেই। বিড়ি ফেলে দিয়ে বাদশা মিয়া দীর্ঘ পায়ে দৌঁড় দেয় ঘরের দিকে। তালা খুলতে গিয়ে ভেজাল বাঁধে। মাঝে মাঝে ঠিক জায়গায় চাপ না দিলে তালাটা খোলে না। হুড়াতাড়া করতে গেলে ঠিকমতো চাপটা হাতে আসে না। একবার বাইরে গিয়ে উঁকি দেয় কোন গাড়ী এসে হর্ন দেয় কিনা দেখার জন্য। এবার চাপ ঠিকমতো পড়ে। ঢকঢক করে খেয়ে নেয় দু গ্লাস পানি। প্লেটে আলুসেদ্ধ, পোড়া শুকনা মরিচ আর ভাত নিয়ে তালা দিয়ে দৌড় দেয়। গেটের কাছাকাছি এসে হর্নের ননস্টপ আওয়াজ শুনতে পায়। থালাটা কোনমতে টুলের উপর রেখে গেট খুলে। আমীর সাহেবের গাড়ি। ‘মাংগির পোলার নোলার শ্যাষ নাই। গাড়ি রাইহা আসি। তোর আইজ টেংরি ভাঙ্গুম ’- ড্রাইভার কাচ নামিয়ে চিৎকার করে। বাদশা মিয়া বিগলিত হাসি হাসে। গাড়ির ভেতরে আমীরের ছোট ছেলের বউ। লিকলিকে।ফরসা। বগলকাটা ব্লাউজ, সিল্কের শাড়ি তার উপর ছোট্ট চুল মাথা আর সেখানকার ঠোঁট ওঠানামা করে। ‘মুরাদ, মুখ খারাপ করো না। এদের খিদে বেশি’। কাচ তুলে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভারী হতে না পেরে বাতাসের সাথে মিশে তৎক্ষণাৎ। হ। কি যেন ভেবে নিজেকে বলে। তারপর ভাতের থালা নিয়ে খেতে বসে। খেতে খেতে ভাবে। মুরাদ বেরোনোর সময় মাস্তানি চালাবে খানিকক্ষণ। আলীর দোকানে চা সিগারেট খাওয়ানো পর্যন্ত খিস্তি করে যাবে। তারপর সব ঠিকঠাক।

মুরাদকে আলীর দোকান থেকে বিদায় দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। ঘড়ির দিকে তাকায়। ল্যাম্পপোস্টের ঈষৎ আলোয় ঘড়ির কাঁটাগুলো ভেসে ভেসে ক্লান্ত হয়। বসে থেকে পাছায় চড়া পড়ে গেছে। হেঁটে হেঁটে কিছুক্ষণ মরা পিচে চাঞ্চল্য ছড়ায়। গেটের বাইরে থেকে একটা নেড়ি কুত্তা ফুচি মারে। উৎসুক হয়ে তাকায় বিবর্ণ চোয়াড়ে পাটকাঠি শরীরের বাদশা মিয়ার চোখে চোখে। এ পাড়ায় কুত্তা ঢোকা নিষেধ। সারমেয় থেকে ভিন্ন প্রজাতির হওয়ায় তার বসন্তের দাগ ভরা মুখে টোল পড়ে।

দুপুরে খানিক বৃষ্টি হয়েছিল। রাতে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে হুসহাস করে। একবার ভাবে ঘরে গিয়ে শালটা গায়ে চড়াবে কিনা। পরে ভাবে থাক। কিছু জমাট কাঁপানো বাতাস প্যান্ট কি শার্টের ফোকর দিয়ে ঢুকে লোমকূপে পিন ফোটায়। একটা রিকশা গেটে এসে বেল দেয়। গেট খুলে যায়। নয়ন ভাই। সিগারেটে কষে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে মারে। বাদশা মিয়ার প্রায় কাঁধ ঘেঁষে উড়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠোকর খেয়ে লাল গলা আলো চুপসাতে থাকে। গেট বন্ধ করতেই কোথা থেকে কিছু অজানা ফুলের গন্ধ নাক বরাবর এসে ঘুষি মারে।

বাদশা মিয়া বৃষ্টির পানিতে পিছলা পিচে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খায়। পড়ে যাবার সময় হাতের লাঠি দিয়ে পড়া ঠেকাতে গিয়ে ডগাটা বুকে গিয়ে লাগে। তীব্রতম ব্যথায় গোঙ্গানির শব্দ বের হয়ে খাবি খায়, পরে ডুব মারে। কোনমতে উঠে টুলে গিয়ে বসে। বুকের কোন জায়গায় লেগেছে দেখার জন্য জামাটা প্রায় খুলে ফেলে। হাড় বের হওয়া লোমহীন বুকে কিছু পরিবর্তন দেখে না এই প্রায় অন্ধ আলোয়। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে আসে। প্যান্টে শার্টে ময়লা কাদা লেগে গেছে। হাত দিয়ে কাপড় ঝাড়ে কিছুক্ষণ। এক জোড়া এই য়্যুনিফর্ম রাতে ধুয়ে দিলেও সকালের মধ্যে শুকাবে না। পরের দিন ভিজা জামা পড়ে দিন কাটানোর কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়।

কালকের কথা ভাবতে গিয়ে তারিখের কথা মনে পড়ে যায়। ষোলোই ডিসেম্বর। গতবার সে এই কাজ করেছিল। এবারো করা লাগবে। এর মধ্যে রাত বারোটা ঠিকঠাক সময়মতো হাজির হয়। কলোনির ছায়া ছায়া অন্ধকার থেকে দুজন যুবক চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘যা বাদাইম্যা ঘুমাইতে যা, ঠিক ছটায় চইলা আইস্।’ থালা লাঠি হাতে নিয়ে বাদশা মিয়া মহল্লার কোমল আলো অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করে। চৌকির ওপর জিনিস দুটো রেখে আবার বেরোয়। এই বাড়ির আরো তিন বাড়ি পর কিছুটা খোলা জায়গা নিয়ে আমীরের বাড়ি। উঁকি মেরে দেখে, দারোয়ান টুলে নেই। আশেপাশে দেখে নেয়। কাউকে চোখে পড়ে না। দুই ঘন্টা আগে খাওয়া দু গ্লাস পানির অবিশ্রাম জলবিয়োগ করতে থাকে আমীরের সদর দরজায়। একটা অত্যাশ্চর্য সুখের ঢেউ সমস্ত শীত ছাপিয়ে ঈষদোষ্ণ পেলবতা ছড়ায় শরীরে। আহা!