টুকুনগল্প

সুহার্তোর রাত্রি

আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকার আধা খ্যাঁচরা মাঠে রাতে জ্যোৎস্না নামে। গুটিসুটি মেরে হামাগুড়ি দেয়। উবু চোখে তাকায় তিন নম্বর বি বাড়ির চার তলার বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে থাকা দাদীর চোখ বরাবর। দাদী অবলীলায় জ্যোৎস্না হজম করে ওচা ঢেঁকুর তোলে। সুহার্তো বারান্দার আরেক কোনায় সিগারেটে টান দিতে দিতে প্রায় অন্ধকার প্রাগৈতিহাসিক আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়ার গোল্লা ওড়ায়। একবার দাদীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। সেখানে জ্যোৎস্না গেলার সোয়াদের রেশ। তিন নাম্বার সি বাড়ির তিন তলার আণ্টি বারান্দায় আসেন। চাঁদের আলো তাকে ফোকাস করতে না পেরে পর্দার চিপায় গিয়ে লকিয়ে পড়ে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে দিয় নিচে। সেটা লালচে আলোর কুসুম ওম নিয়ে শূন্যে উড়াল দেয়। হুইল চেয়ার ঠেলে দাদীকে বারান্দা থেকে বের করতে গেলে জড় শরীরটা কেঁপে ওঠে। নিয়ে যায় ড্রয়িংরুমে। আব্বা সেখানে লোলুপ চোখে টিভির পাঠিকার ওজন মাপে। শব্দ শুনে পেছনে ফিরে আবার ওজন মাপায় মন দেয়। দাদীর অসীম চোখ টিভির স্ক্রিন পেরিয়ে মাঠ ঘাট নগর বন্দর পেরিয়ে কোন বটগাছের নিচে ছায়া খোঁজে।হয়ত।

ছোটবোন সুকি পাশের ঘরে ঠকঠক গোঁ গোঁ আওয়াজ করে। সাথে পাঠিকার একই সুরের সংবাদ পড়া। ছোটভাই স্তালিনের প্লে-স্টেশনের আওয়াজ। আম্মার রান্নাঘরের টুকটাক। সব শব্দ মিলেমিশে বীট তৈরি করে। আব্বার টাক মাথায় দেয়াল বানিয়ে পুরা ঘরে ইকো ইকো খেলা করে। সুহার্তো ঢুকে পরে সুকির রুমে। এক পা বিছানায় রেখে অন্য পায়ে জুতা পড়ে ঠক ঠক করে শব্দ করে যায়। বড় ভাই রুমে ঢোকায় তার কাজের কোন ভিন্নতা ঘটে না। মুখে লালার গ্যাঁজলা নিয়ে গরর গরর করে আওয়াজ করতে থাকে। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ রুমে। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে মাথা ঘোরে। ‘এই রাবেয়া, সুকির মুখটা একটু মুইছা দিয়া যা’। সুহার্তো প্লে-স্টেশনের আওয়াজ ডিঙ্গিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। দরজা টেনে দেয়। ভার্সিটির শেষ বছরটা আর শেষ হয় না। ফাইনাল পরীক্ষার ডেট এই নিয়ে দুইবার বদলে গেছে। আরো এক মাস পরে হয়ত শুরু হতে পারে। কম্প্যুটারে দেখে নতুন কোন মেইল আসছে কিনা। ফেসবুকে ইউজার নেমে টাইপ করে পাসোয়ার্ড দিতে আর ইচ্ছা করে না। সাট ডাউন করে দেয়। সুকির গরর গরর শব্দ আরো পেখম মেলে। দিন পনের আগে রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল। অনেক পরে চোখ লেগে আসামাত্র সুকির বীভৎস চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাথা আর ঠান্ডা রাখতে না পেরে উঠে গিয়ে সুকিকে জোরে এক চড় দিয়ে বসে। আম্মা সেই থেকে সুহার্তোর সাথে কোন কথা বলেনি। সুকির রুমে রাতে এখন লক দিয়ে রাখা হয়। সুহার্তো গায়ে একটা জামা গলিয়ে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নেয়।

‘রাবেয়া, দরজাটা একটু লাগায়া দে’। সিঁড়ির ধাপগুলো ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কলোনির রাস্তায় নিজেকে নামিয়ে আনতে বেশি সময় লাগে না। একটু একটু শীত আবছা হাওয়ায় উড়ে উড়ে নাকে মুখে চোখে লাগে। কলোনির রাস্তায় আর কেউ না থাকায় নিজের পায়ের আওয়াজ কানে শব্দ ঢেলে দেয়। রনিদের বাসায় নিচতলায় সন্ধ্যা থেকে ক্যারাম খেলার আসর জমে। সেখানে একটা পাড়া কমিটি ও আছে। চালায় রুম্মান। সে পাড়ায় বেশ ক্ষমতা রাখে। ইডেনের এক নেত্রীর সাথে ডেট ও মারে। ওর দলের কিছু পোলাপাইন ভালোই টেরর। তবে কলোনিতে চাঁদাবাজি মাস্তানি না করে একটা লিডার টাইপ ভাব নেয়। এদের ক্যারাম খেলা চলে অনেক রাত পর্যন্ত। সুহার্তো ওদের ডেরায় গিয়ে ঢোকে।

‘কি সুহার্তু মিয়া, এতো রাইতে এহানে’। রেডের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে রুম্মান প্রশ্ন করে।

‘একটু বাইরে যাইতেছিলাম। ভাবলাম একটু ঘুরে যাই।’

‘আরে কই যাবি। এখানে থাক। এই বোর্ড শেষ হইলে খেলতে পারবি।’ সজীব ও রেড টার্গেট করতে গিয়ে ব্যারাছ্যারা করে ফেলে। রুম্মানের দলে খেলে রিপন। সজীব আবির একদল।

‘রিপইন্যা, রেড ফালাইতে অইবো কিন্তু।’

রিপনের হাতে টেনশন ভর করে। রেড প্রায় ঢুকতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে না ঢোকার সিদ্ধান্ত নেয়। আবিরের স্ট্রাইকারের হালকা চুমু খেয়ে রেড গর্তের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়। একটা কাল গুটি রেডের পথ ধরে।

‘রিপইন্যারে দিয়া কিছু অইবো না।’ রুম্মান এই কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টায়। ‘তুমার বইনরে নিয়া তুমার আম্মায় ইণ্ডিয়া গেছিল। কিছু অইছে?’

‘আরে না। অটিস্টিক কোনদিন ভাল হয় নাকি। আম্মা গিয়া দ্যাখে খালি।’

বোর্ডে আর পাঁচটা গুটি। দুইটা সাদা, তিনটা কালো। রুম্মান একটা সাদা ফেলে দেয়।আরেকটাকে সাইজ করে।

সুহার্তো বলে - ‘এখন যাই।’

‘আইচ্ছা হোনো। কাইল বিকালে স্টার কাবাবে মামু পার্টি দিছে। আইসো।’- রুম্মান দেখে সজীব দুইটা কালো হাপিস করে দিয়ে শেষেরটাকে প্রায় ফেলতে যায়। গর্তের মুখে কালো গুটি কারণ ছাড়াই ব্রেক মারে। এবার রিপনের পালা।

‘দেখি, যামুনে।’ বলে সুহার্তো বেরিয়ে আসে।

কলোনির রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছুর স্রোত মাথায় টোকা মারে। আব্বা। আম্মা। সুকি। স্তালিন। দাদীর প্যারালাইসিস। রিনা। রিনার কানের দুল। কপালের টিপ। হলদে ডুরে শাড়ি। রাস্তাগুলো পথ পেরোয় দ্রুত পায়ে। একসময় এসে পড়ে সুবলদাস রোডে। আরো কিছুদূর এগোলে নীলাম্বর শাহ রোড। রিনাদের বাসা।

পকেটের মোবাইল বেজে ওঠে। বাসা থেকে। আম্মা। ‘তোর দাদী ……’। আম্মা কথা শেষ না করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রিনা তার ফরসা হাত হলদে ডুরে শাড়ি কপালের টিপ সহ পাশের ম্যানহোলে অকস্মাৎ আশ্রয় নেয়। সুহার্তো দৌঁড়ায় বাসার দিকে। সুবলদাস রোড পেরিয়ে গেলে মানুষের ভিড় একটু ভারি হয়। কাবার ঘরের সেঁকা কাবারের গন্ধ। আব্বাস মিয়ার তেহারির দোকানের ডেকচি খোলার সাথে সাথে ভ্যাঁপসা গন্ধের ঢেউ। রিকশা বাস কারের ঐক্যবদ্ধ কলতান। ফলের দোকানের উজ্জ্বল বাতিতে কমলা আপেলের শরীরের পেলবতা। দৌঁড়। দৌঁড়। দৌঁড়। মনা মিয়ার চায়ের কেটলি দিয়ে বের হওয়া ধোঁয়ার হেঁচকি। রিকশার পাম্পওয়ালার হাতের পেশির ওঠানামা। ফুটপাতে দোকানের পর দোকান। একদুইজন মানুষের সাথে গায়ে ধাক্কা লাগা। দৌঁড়। দৌঁড়। দৌঁড়। মীনা মাসির ভাপা পিঠার দোকান। অর্ণবের ডিভিডির আড়ৎ। মোসাদ্দেকের সিগারেটের দোকান। নগর রাতবাতির হলদে বিলাস। গেট। দারোয়ান মতি ভাই। সব পেরিয়ে কলোনিতে ঢুকে পড়ে সুহার্তো। বাসার নিচে দাঁড় করানো আছে একটা এম্বুলেন্স। সিঁড়ি উড়িয়ে দিয়ে বাসায় ঢুকে দেখে দাদী এখনো হুইল চেয়ারে। মুখে জ্যোৎস্না গেলা সেই সৌম্য চেহারা। চোখ খোলা। বারান্দায় সিগারেটটা আজ না খেলেই হত।