টুকুনগল্প

পা

আমিনবাজারে অন্যান্য দিনের মতোই বিকেল শেষ হয়। এই সময়ে মহল্লার ছেলেরা ট্রিগার টিপুর কারিশমা নিয়ে গল্প করে। টিপুর নিশানায় মাদকসম্রাট আজম ঘায়েল হওয়ায় মহল্লাতে অন্য বিষয় নিয়ে গল্পের দরকার পড়ে না। প্রয়োজনমাফিক ফেন্সি চালানোর পর কড়াচিনি চায়ের স্বাদ ওদের জিহ্বায় খোঁচা দেয়, সাথে টিপুর ট্রিগার চাপার ছবি চোখে স্পষ্ট হয়। হাতের আঙ্গুল দিয়ে বুম বুম করে একে অন্যকে কাল্পনিক গুলি চালায়। গুলি লাগার পর দু চারজন লুটিয়ে পড়েও গুলি করা চালু রাখে। এত গোলাগুলির হাঙ্গামায় একজনের হাতে লেগে কোন একটা চায়ের কাপ মাটিতে পড়ে ভাঙ্গে। অবশিষ্ট চা ভাঙ্গা পিচে না গড়িয়ে ঘন চিনি গায়ে নিয়ে স্থির থাকে। চায়ের দোকানদার পানের পিক ফেলে মহল্লার ছেলেদের মা কিংবা বোনের সাথে নিচু গলায় মৌখিক কুকর্ম করে। বিকেল, শেষ বিকেলে গড়ায়।

মহল্লায় কোন না কোন নতুন বাড়ি বানানোর জন্য চিপা রাস্তায় বালি ইট রড স্তূপ হয়ে থাকে। বালির ঢিবি বস্তির পিচ্চিদের জাম্প প্র্যাকটিস করার আসর হয়। তরমুজ বিক্রেতাদের ঠেলাগাড়িতে সারি সারি মসৃণ সবুজ তরমুজ; ফালি করা তরমুজের লাল বিকিরণ মাছির ডানায় ভর করে ওড়ে। রেণু ছড়ায়। লতিফের পিঁয়াজুর দোকানে প্লেটে নেয়া আঠারোটা পিঁয়াজু অনায়াশে হজম করে একজন বারোটার দাম দিতে গেলে লতিফ গাণিতিক সমস্যায় অবাক হয়ে তাকায়। ‘আবালের মত চায়া আছো কেন মিয়া, ট্যাহা ফেরত দাও।’ লতিফ আর কথা বাড়ায় না বরং টাকা ফেরত দেয়। দূরে কোথাও সাংসদ আজাদের বক্তৃতা মাইকের গলা দিয়ে বেরোয়। ডাইং মিল, পেপার ফ্যাক্টরি, অজস্র ইটের ভাটার চিমনি দিয়ে বেরোনো ধোঁয়ার সাথে মিলে আজাদের গলা অস্পষ্ট ঘ্যাড়ঘেড়ে লাগে।

সন্ধ্যা হতে আর দেরি নেই। মহল্লার ঘরবাড়ির সরু ফাঁকে স্কুলের কিছু ছেলে আলো বাঁচিয়ে ক্রিকেট খেলে। দিনের খেলার শেষ বলটা ব্যাটসম্যান জোরে পিটাতে গেলে বল গিয়ে এক বাড়ি্র জানালার কাচে লাগে। আশ্চর্য কাচ না ভেঙ্গে ঠিক থাকে। এক পিচ্চি বল আনতে গিয়ে জানালা দিয়ে তাও একবার উঁকি দেয়। ঘরের ভেতর বাতি না জ্বালানো থাকায় প্রায় অন্ধকার। জানালা থেকে একটু দূরে হুইল চেয়ারে কাটা-নাসির বসে আছে। লোমশ হাঁটুর নিচে কাটা জায়গার অনাবিল মসৃণতা দেখে পিচ্চির হাসি পায়। ফিক করে হেসে ফেলে। পরে বল নিয়ে বন্ধুদের সাথে বাড়ির পথ ধরে।

ইদানীং নাসিরের অদৃশ্য পায়ে ব্যথা হয়। বিশেষত ডান পায়ে। গত সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর শোনে এটা একটা সিন্ড্রোম। নাম ফ্যান্টম লিম্ব সিন্ড্রোম। রোগী তার কাটা পায়ের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে না পেরে এক সময় ধরে নেয় সেখানে আসল পা আছে। তখন থেকেই ব্যথার শুরু। পা নেই এটা ভেবে নিলেই সমস্যা কেটে যাবে। ডাক্তারের কথামতো পা নেই ভাবা ধরতেই আমিনবাজারের ব্রীজের নিচে দুই পা হারানোর বিভৎস স্মৃতি ফিরে আসে।সাংসদ আজাদের পোষা সন্ত্রাসীরা করাত দিয়ে তার দু পা কেটেছিল দীর্ঘ সময় নিয়ে। সেই ভয়াবহ ব্যথা ফিরে আসায় ফ্যান্টম লিম্বের ভূতুড়ে ব্যথায় ফিরে যাওয়ার জন্য ককায় নাসির। এখন এই প্রায়-সন্ধ্যায় প্রার্থিত অদৃশ্য পা ফিরে আসে। সাথে ব্যথা। ঠিক তখন ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা একটা তরমুজ হা করে তাকায় নাসিরের দিকে। তরমুজের নিঁখুত জ্যামিতিক গঠন আর তার অশ্লীল কি প্রফেন আচরণ দেখে নাসির তার অদৃশ্য পা দিয়ে তীব্র জোরে লাথি কষায়। তরমুজকে।