টুকুনগল্প

আরগস

ও অফিসে রওনা হলে আমি নিজের মতো একা হয়ে পড়ি। চুলায় পানি ফোটাতে দেই। ডাইনিং টেবিলে পড়ে থাকা এঁটো থালা আর অর্ধেক চা-সহ চায়ের কাপ সিঙ্কে রেখে পানি ছাড়ি। চায়ের বাকিটা আস্তে আস্তে রঙ পালটে পানির রঙ নিতে থাকে। পানি ফুটে গেলে কাপে ঢেলে চায়ের একটা ব্যাগ ছাড়ি। পানি তার বর্ণ বদলায়। দেয়ালে একটা টিকটিকি টিক-টিক আওয়াজ করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমাদের ছবির পেছনে অদৃশ্য হয়।

আমরা ভালোবাসাবাসির ও রাগ-অভিমানের দীর্ঘ প্রেমপর্ব কাটিয়ে বিয়ে করি। কিভাবে যেন আমি বুঝে ওঠার আগেই ও আমার ওপর জেঁকে বসে। আমার গান করা, ছবি আঁকা, কবিতা পড়া, কবিতা লেখা, একাকী নির্জনতম আমার সব সুদীর্ঘ স্বপ্ন ও চিন্তা একটা সময় পরে আপনা থেকেই গুটিয়ে যায়। তবে ওকে ভালোবাসা আমি কমিয়ে ফেলি না। প্রতিদিন সকালে একাকী চা খেতে গেলে একটা দিনের কথা মনে পড়ে। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে সেদিন ওর বিশ্রীরকম মেজাজ দেখানো আশেপাশের লোকজনের ধার ধারেনি। আমিও খুব রেগেছিলাম। মুখ ফসকে বলেছিলাম- তোমার উচিত কোনো পতিতাকে বিয়ে করা। যার কোনো পরিবার পরিজন নেই। আমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে ওর মুখ শুকিয়ে যায়। আমিও আর কথা ফিরে পাই না। আমার অত পড়ুয়া হবু বরের মধ্যের ট্যাবুকে কিছুটা যেন চিনেছিলাম সেদিন। পরে কোনো এক ভালোবাসাময় দিনে এই কথা বলার জন্য ওর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেই। পতিতাদের পরিবার থাকতে নেই কেন মনে হয়েছিল সেইদিন, সেইসময়!

এক একটা সম্পর্ক এক একভাবে এগোয়। প্রতিটা অসুখী পরিবারের গল্প নাকি ভিন্ন। সুখী পরিবারগুলো একই চৌকানা বাক্সে অদৃশ্য থেকে যায় বলে তাদের গল্প আমার জানা নেই। বাবা-মার সাথে আমার যে পরিবার সেটার সুখী ভাব নিয়ে একটা সময় পর্যন্ত কোনো সন্দেহ ছিল না। বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ট্রেনে করে গ্রামের বাড়ী যেতেন। ফিরতেন শনিবার দুপুরে। একদিন জানতে পারি গ্রামে বাবার আরেক বউয়ের কথা। ততদিনে শরীর, স্তন, যোনী ও সঙ্গম চিনে গেছি। বাবাকে অল্প ঘৃণা করতে শুরু করি। কিন্তু মার সুখী সুখী চেহারা বাবার প্রতি ঘৃণা বাড়াতে অবাধ্য করে।

ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয় বিয়ের আগেই। দিনটার কোনো কথাই আমার মনে নেই। সেই সময় বান্ধবীরা তাদের ছেলেবন্ধুদের খুনসুটির কথা বলে বলে একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়তো। আমার অনভ্যস্ত মুখে কোনো গল্প শুনতে পায় নি বলে আমাকেও খেপাতো। ঠিক কতোদিনের মাথায় ফ্রিজিড গালিটা শুনি পরিষ্কার মাথায় আসে না। অন্যান্য গালিগুলো শোনার আগেই আমি নিজের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে পড়ার অভ্যাস শুরু করি।

কিছুক্ষণ পরেই ওর ফোন আসে। মিস্টার আম্বানি। দুপুর দেড়টা। ভারতীয় ডেলিগেট। একটু চুপ থেকে ফিসফিস করে উচ্চারণ করে- ফ্যালাসিও।

খুব তৃষ্ণা পায়। অনেকগুলো আধ লিটারের পানির বোতল স্তুপ করে রাখা আছে স্টোররুমে। একটা বোতল নিয়ে ফ্রিজে ঢোকাই। পানি ঠাণ্ডা হবার জন্য নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকি।


ফিরে: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের যুগলবন্দি গল্পের এলসেশিয়ান আরগস। গল্পের নাম সেখান থেকেই।