টুকুনগল্প

প্রথম রাজহংসী

-তুই অমন কইরা আমার দিকে চাইয়া আছোস ক্যান?

আব্বার কথা শুনে আমি বাপের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকাই। দাদী মারা গেছে এই ঘন্টাখানেক আগে। আমার কোলেই। তার আগে আব্বা, আম্মা, বড়ভাই সাথে আরো সবাই এই ঘরেই ছিল। আমিও ছিলাম। আব্বা দাদীর কষ্ট বেশিক্ষণ দেখতে পারে না। কিছুক্ষণ থেকেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। গ্রামের এই বাড়িটার পিছনের দিকে এক ঘরে দাদী একা একা মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছিল গত প্রায় দুই বছর। শহরের দুই ঘরের বাসায় আমরা দুই ভাই, আব্বা-আম্মা, পাগলা ফুফি আর দাদী থাকতাম একসাথে। দাদী বয়সের কারণে অসুস্থ হতে থাকলে একা একা সব সামলাতে না পেরে আম্মা আব্বার সাথে একদিন তুমুল ঝগড়া করে বাসা অস্থির করে ফেলে। আব্বা রেগে গিয়ে আম্মার পিঠে ঘুষি মেরে ঘরের বাইরে চলে যায়। পরদিন দাদী নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। আব্বা আম্মার দিকে আবার তেড়ে গেলে দাদী আটকায়। পরে দাদী গ্রামে ফিরে আসে। ফুফি পাগল বিধায় দাদীর চলে আসার সময় দাদীর দিকে তাকিয়ে হাসে। দাদী যাওয়ার আগে আত্মজারে ছুঁতে গেলে ফুফি ‘বুড়ি ঢ্যামনির রঙ’ বলে গালি দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়। আমরা শহরে থেকে দাদীর মৃত্যুর দিন গুণতে থাকি। ফুফি একাএকা আরো পাগল হতে থাকে। গ্রাম থেকে একদিন শরীর হঠাৎ বেশি খারাপ করার কথা জানতে পেরে আমরা সবাই গ্রামে ফিরি। বয়সজনিত রোগে দাদীর শরীরের চামড়া খুলে বিছানার সাথে লেগে যায়। কথা বন্ধ। শরীর নাড়াতে পারে না। বয়স্ক মৃত চামড়ার সোঁদা গন্ধ ঘরটাকে বিষন্ন করে ফেলে। আব্বা, আম্মা, বড়ভাই ও অন্যান্যরা ঘর ছেড়ে বেরোয়। আমি একা থেকে যাই দাদীর সাথে। কি মনে করে বিছানায় বসে দাদীর মাথাটা আমার কোলে নিতে গেলেই বিছানার সাথে লেগে উঠে আসা চামড়ার যন্ত্রণা ভুলে দাদী আমার দিকে হেসে একদম থেমে যায়। মৃত্যু না দেখে অভ্যস্ত আমিও বুঝে যাই এটা হয়তো মৃত্যু। হাসিটা অপার্থিব। আমার বিজ্ঞান জানা মাথা হঠাৎ করে চঞ্চল হয়। আমি দরজা জানালা বন্ধ করে আত্মা আটকাতে শুরু করি। দাদী অপার্থিব হাসি নিয়ে চোখ খুলে রাখে।

-দাদী, তুমি কি আত্মা হৈয়া গেছো? শুনতেছ আমার কথা?

আমার কথা শুনে দেহ নিয়ে দাদী অনড় থাকে। সিলিং ফ্যানের বাতাসে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়লে আমি আবারো প্রশ্ন করি। দাদীর আত্মা আমার সাথে কথা বলতে আগায় না। আরো কিছুক্ষণ এইসব করি। পরে শুনি দরজায় সবার মিলে কিল ঘুষি মারার শব্দ। খুলে দিতেই আব্বা, আম্মা, অন্যান্যরা হুড়মুড় করে ঢোকে।

-তুই দরজা বাইন্ধা একা একা কি করছ?

আব্বার চোখ মুখ চেহারা একযোগে ক্রুর হওয়ার আগেই আম্মার চিৎকারে সেটা আর ফোটে না। আব্বা চিৎকার করতে থাকে ‘ও আম্মা, ও আম্মা, আমারে তুমি একলা ফালাইয়া চৈলা গেলা’ বলে। আমি দাদীর হাসি দেখি। কে যেন এসে দাদীর খোলা চোখ বন্ধ করে দেয়। দাদীর হাসিটা তখনি অদৃশ্য হয়। আম্মা ও কাঁদতে থাকে। আব্বাকে কখনো কাঁদতে দেখি নাই। তাই আব্বার কান্না অপলকে দেখতে থাকি। আব্বা সেটা খেয়াল করে।

-তুই অমন কইরা আমার দিকে চাইয়া আছোস ক্যান?

আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। ঘরটা আস্তে আস্তে অন্যান্যদের কবলে চলে যায়। আমি একা হয়ে পুকুর পাড়ে চলে আসি। ফুফি একা একা শহরে তার আম্মার মৃত্যু সংবাদ এখনো জানে না দেখে মন খারাপ করি। বড়ভাই পুকুরের পাড় ঘেঁষে হেঁটে চলে যায়। আমার দিকে ফিরে তাকায় পর্যন্ত না। আমি দাদীর কথা ভাবতে থাকি।

আব্বা যা করে সেটা ঠিক ব্যবসা বলা যায় না। মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা আসে। আব্বা খুব খেতে ভালোবাসে। গোগ্রাসে সপরিবারে ক্ষুধা মিটিয়ে আর সিগারেটের পর সিগারেট টেনে আব্বার টাকা শেষ হয়ে যায়। দাদী আমাকে খুব আদর করতো। বড়ভাইকেও। ফুফি ঠিক আদর করতে জানে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম মাঝে মাঝে বলতো- আয় তোগো মুখে পাউডার দিয়া দিই। আমরা দুজনে মুখ নিয়ে হাজির হলেই ফুফি বক্সিং মারার মতো করে আমাদের মুখে পাউডার পাফ মারতো। ধবল মুখ নিয়ে একটা ছোট্ট আয়নায় আমরা দুইভাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নিজের মুখের অংশ বাড়িয়ে দেখার যুদ্ধ করতাম। দাদী হাসতো। আম্মা এইসব দেখে গজগজ করে সাদা ভূতদের মুখ ধুইয়ে দেয়। ফুফি তখন হাসতে থাকে, আর দাদী কেমন জানি গম্ভীর হয়ে যায়। দাদী আমাদের দিত স্বার্থপরতা শেখার উপদেশ। দাদীর উপদেশ পরে একদিন আইজ্যাক বাবেলের গল্পের দাদীর উপদেশের সাথে মিলে যায়। দাদী তখন গ্রামে থাকে। আমি দাদীকে জানাতে পারি না- ও দাদী, তোমার গল্প দেখি বাবেলের দাদীর গল্পের লগে মিইল্যা গেছে। দাদীকে আমার এই মহা-আবিষ্কার জানিয়ে চিঠি লিখি। দাদীর প্রত্যুত্তর তার মৃত্যুর আগেও পাই না। দাদীর আত্মা পুকুরপাড়ে থাকতে পারে ভেবে তাও একবার জিজ্ঞেস করি।

-দাদী, তুমি আমাদের অমন স্বার্থপরতার কথা শেখাতা ক্যান?

দাদী আমাদের বলতো- পড়্‌ পড়্‌। ভালোমতো পড়্‌। পড়ালেখা শিখলেই টাকাপয়সা সব পাবি। লোকজন আইসা তোগো তোয়াজ করবো, মাইন্যগইন্য করবো। আর মাইনষেরে এক্কেরে বিশ্বাস করবি না। মনে রাখবি- বন্ধু হৈতেছে বন্দুক। আর হাওলাত দিবি না খবরদার। দাদীর কথাগুলো কিছুটা ঘুরিয়ে আব্বাও করতো। এখনো করে। আম্মাও। আমাদের ছোট্ট বাসাটা পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রাথমিক স্বার্থপরতা শেখানোর পাঠশালা হয়ে পড়ে। আর আমরা দুইভাই পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রাথমিক অস্ত্রশিক্ষার মহড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকি। আব্বা পড়ার বইয়ের বাইরের বই দেখলেই ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। দাদী এটাতে রাগ করতো- ঐ তুই বই ছিঁড়স ক্যান? বই ছিঁড়ন না পাপ? আব্বা বলে- তুমি বুড়ি, ঐসব বুঝবা না। তোমার নাতি নুনু ফোলার বই পড়ে। আমি দাদীর দিকে আর তাকাতে পারিনা। দাদী অন্ধকার হয়ে যায়। ফুফি হেসে ওঠে খিলখিল করে। আম্মা বোধহয় কাঁদে।

আমি অল্প অল্প অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকি। দূর থেকে সদ্য মৃত হয়ে পড়া দাদীর মৃতদেহ নিয়ে শোরগোলের কিছু কিছু শব্দ আসে। আমি হঠাৎ পুকুরে দেখতে পাই একটা রাজহংসী। আমার দেখা প্রথম রাজহংসী। বাবেলের গল্পের প্রথম রাজহংসী।