টুকুনগল্প

সসেমিরা

রাতের খাবার কখন দেয় কে জানে? আমার খালি খিদা লাগে। এখানকার খাওয়া মুখে রোচে না। তাও গিলে গিলে খাই। পেট ভরিয়ে ফেলি। এখানে পড়ে আছি অনেক দিন অনেক মাস অনেক বছর। ইদানীং বাবা আমাকে আর দেখতে আসে না। বাবা বোধহয় আর পারছে না। এদিকে ডাক্তার আমার পুরানো জামাকাপড় পাল্টে দিচ্ছে না। আমি ময়লা জামা পড়ে দিনের পর দিন থাকছি। ডাক্তারকে বলেছিলাম। হাসে। বলে- তোর আব্বায় না দিলে পাবি কেমতে?

পায়ে শিকল মেরে রাখে রাতদিন। রাতে কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে হয় পায়ের উপর কোন পাহাড় আটকে আছে। ব্যথায় নীল হয়ে যাই। নড়তে পারি না, নাড়াতে পারি না কিছু। দমবন্ধ হয়ে আসে। নিজের চিৎকার হজম করে ফেলি। এখানে অনর্থক চিৎকার করলে প্রচুর মারে। আমি প্রথম প্রথম খুব মার খেতাম। এখন চালাক হয়ে গেছি। শিখে গেছি কিভাবে চিৎকার গিলতে হয়। আমি সারাদিন আমার ঘরে থাকি। একা একা। মাঝে মাঝে ওরা বের করে। গোসল করানোর জন্য। আমার একদম ভালো লাগে না গোসল। কিন্তু ওরা টেনে নিয়ে যায়। পায়ে শিকল বাঁধা নিয়ে গুটি গুটি হেঁটে যাই। এক দুই জনের গায়ে নতুন জামা দেখা যায়। ওদের বাবা-মা এখনো বোধহয় দেখা করতে আসে। এক জায়গায় কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে পাইপ দিয়ে পানি মেরে মেরে গোসল করানো হয়। আমার কখনো কখনো দমবন্ধ হয়ে আসে।এখন শীতকাল। জায়গাটাতে হু হু করা ঠান্ডা বাতাস। ঘরের দিকে যেতে যেতে শীতে মরতে থাকি।

আমার বিছানায় আমি ঝিম মেরে থাকি। পাশ ফিরলে পায়ের শিকল শোর করে। গরগর একটা শব্দ আসে পাশের ঘর থেকে। সেখানে থাকে রুম্মান। বয়েস বেশি না। ওর চোখ সবসময় টকটকে লাল দেখি। আর রাজ্যের খিস্তি মুখে লেগে থাকে। নতুন নতুন অনেক গাল ওর মুখে শোনা যায়। আমাকে নানান গাল দিয়ে সম্বোধন করে। আজ যাওয়ার পথে আমায় ডাকলো খাউজানি চোদা।

নীলুর বাপ থাকে আমার সামনের কামরায়। উনি এখানের সবচে পুরানো লোক। কখনো কোন কথা বলেন না। সুইপার রহমান আমার রুম পরিষ্কার করতে আসলে আমার সাথে কথা পাড়ে। কাল বললো- আপনে তো মামা আর পাগল নাই। আপনেরে এইহানে রাইখ্যা দেওনের মতলব বুঝলাম না। বাড়ি পাঠাইয়া দিবার পারে আপনেরে। আমি শুনে হাসি। আমি এই জায়গার বাসিন্দাদের সব খবর পাই রহমানের কাছ থেকে। নীলুর বাপের কথা ও জেনেছি ওর মুখেই। তার গ্রামে একবার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। বউ আর দুই যমজ বাচ্চাকে পানি টান দিয়ে নিয়ে গেছিল নীলুর বাপের সামনে থেকে। তারপর থেকে এই রোগ। বলে না কোন কথা। শুনে ও না বোধহয়। নড়াচড়া করে না একদম। যেখানে যেভাবে থাকে সেখানেই পেশাব পায়খানা করে ফেলে। রহমান খুব খিস্তি করে নীলুর বাপকে। ডাকে হাগুমুতুবাবা।

আমার আজকাল এখানে থাকতে আর খারাপ লাগে না। কিভাবে কিভাবে যেন সময় কেটে যায়। আগে বাজে দুর্গন্ধে থাকতে কষ্ট হতো। এখন কেটে গেছে। শুধু থেকে গেছে পায়ের ব্যথাটা। রহমান বলে আমি ভালো হয়ে গেছি। কিন্তু এরকমই তো ছিলাম সারাটা জীবন। আমার মধ্যের আমির সাথে সারাজীবন কথা বলে গেছি। নির্জনে। মা মারা যান আমার বয়েস যখন তিন। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা বিয়ে করতে পারতো, তবে করে নি। বাবা আমার সাথে মিশতো। আবার মিশতো না। আমাকে ভালবাসত কি? আমি কি বাবার ছেলের মতো হতে পেরেছিলাম? একদম না। বাবার কাছে থেকে যতোটা দূরে পারা যায় আমি থাকতে চাইতাম। আমি চাইতেই পারি। বাবা বড় ব্যবসায়ী। নানান জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে চাই্তো, পরিচয় করিয়ে দিতে চাইতো। আমি এড়িয়ে যেতাম। বেশি জোর করলে আমি ও আমার মতো জোর খাটাতাম। স্কুলে কাউকে আমার ভালো লাগতো না। সবাই আমার পিছনে লাগতো। লুলু লুমি নামে ভ্যাংচাতো। আমার শার্টে একবার নানান অকথা কুকথা লিখে ভরিয়ে দিলো। বাবা শার্ট দেখে গাড়িতেই আমাকে চড় মারলো। কয়েকদিন বাদে আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।বাসায় তিনজন স্যার রাখা হলো। বাবার বন্ধু একজন মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। হরেক কিসিমের পরীক্ষার পর ও উনি কোন কুলকিনারা করতে পারলেন না। বাবা ও মাঝে মাঝে যেত আমার সাথে। বাবার সাথে কোন কথা হয়নি সেই কতকাল।

বাসার স্যারদের মধ্যে একজন আমার বুকে হাত রাখতেন। হাতে মুখে আদর করতেন।পরে একদিন আমার সাথে ওইসব করলেন। আমি ব্যথায় কেঁদে উঠেছিলাম। চুমু খেয়ে বলেছিলেন- বাবু এরপর আর ব্যথা লাগবে না। দিনের পর দিন এসব চলছিল। পরে আমার ও ভালো লাগতো। কাউকে বলিও নি। আমি প্রাইভেটে এইচএসসি দিয়ে পাস করলাম। বাবা আমাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালো না। বাসায় স্যারদের আসা বন্ধ হয়ে গেলো। আমার সময় কাটতো না।বাবার বই কেনার বাতিক ছিল। কারণে অকারণে নানান বই কিনে বাসা ভরিয়ে ফেলেছিলো। খুব একটা যে পড়তো তা কিন্তু নয়। আমি সময় কাটাতে বই পড়া ধরলাম। দিন রাত পড়তাম। বাবা দেখতো, কিছু বলতো না। একদিন কি যেন হলো। হঠাৎ। বইয়ের পাতার কাল অক্ষর আমি আর দেখতে পারছিলাম না। পাতার পর পাতা অসহ্য সাদায় আমি কেমন জানি হয়ে গেলাম। আমার চোখ থেকে পৃথিবীর সব কালো অক্ষর যেন আকাশে উড়ে গেল। আমি বই ছেঁড়া শুরু করলাম। বইয়ের পর বই, বইয়ের পর বই। বাবা বাসায় ফিরে সব দেখে চুপচাপ বসে ছিলো।আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না কেন এসব করেছি।

পরদিন সকালে দেখি বাবা ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আমাকে বললো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে। আমি তৈরি হয়ে বাবার সাথে বেরোলাম। গাড়ি চলতে চলতে চলতে আমাকে নিয়ে হাজির করলো এখানে। সে এক দীর্ঘ দীর্ঘতম জার্নি বাই কার।