টুকুনগল্প

হরিকেল

আমাদের পাড়া দুপুরে একা একা ঝিমায়। মহাসড়ক থেকে প্রথমে পড়ে ইটের ভাটা। তার পাশের চিকন রাস্তা দিয়ে মাইল খানেক রিকশা বা হেঁটে আসলেই এই পাড়া। ইটের ভাটা দুপুরে বিশ্রাম নেয় না। সেখানকার চিমনি থেকে ধোয়া বেরোনোতে তাই কোনো বিরতি নেই। পাড়ার পুবদিকের বস্তির ছেলেবুড়ো অনেকেই ইটের ভাটায় কাজ করে। রোদ, ভাটার গরম ও ইটের গুড়োয় ভাটায় কাজ করা লোকগুলো গিরগিটির মতো রঙ পালটে লাল দানো হয়ে পড়ে। পাড়ার বাচ্চারা কখনো বা বল কুড়াতে ইটের ভাটায় গেলে লাল দানোদের দেখে পালিয়ে ফিরে আসে।

পাড়ার বিড়ালেরা দুপুরে ডাস্টবিন থেকে তাদের প্রয়োজনমতো খাবার খেয়ে শরীর এলিয়ে দেয়। কুকুরগুলো ঝিমাতেই থাকে। একটা দুইটা উঠে কোথাও গিয়ে খাবার শুঁকে। পরে কিসব ভেবে কাছাকাছি কোথাও শুয়ে পড়ে। রিকশা বা সাইকেলের বেল শুনলে আলস্য নিয়ে একটু করে চোখ খুলে, তারপরে আবার বন্ধ করে ভাবনামগ্ন হয়। কাকমণ্ডলী গাছের ডালে, ইলেকট্রিক তারের ওপর, কার্নিশে বসে থাকে। এক দুইজন কারণ ছাড়াই কিছুক্ষণ উড়ে আবার অন্য কোনো কার্নিশ, ইলেকট্রিক তার কিংবা গাছের ডালে গিয়ে বসে। চড়ুইরা একটু একটু উড়ে। কিছু না কিছু খুঁটে। মাঝে মাঝে চড়ুইনিদের তাড়া করে।

পাড়ার ক্লাবে লো ভলিউমে টিভি ছেড়ে রাখা। দুইজন আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। তৃতীয়জন পেপার নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে পত্রিকায়, মাঝে মাঝে টিভি দেখার মাল্টিটাস্কিং বিশ্বস্ততার সাথে করার চেষ্টা করে ভদ্রলোক। টানা হলঘরের অন্য কোণায় ক্যারাম খেলছে চারজন। খেলার চেয়ে কথার জোর বেশি হওয়ায় টিভির দর্শকেরা কিছুটা বিরক্তি দেখালেও সেটাতে গা করে না ক্যারামওয়ালারা। দেয়ালে ঝুলানো আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। একেবারে নির্বিরোধ, চুপচাপ। কিছুদিন আগে একই দেয়ালে শান্তভাবে ঝুলে থাকতেন জেনারেল জিয়া। একটা টিকটিকি টিকটিক করে আওয়াজ করে। পত্রিকার পাঠক আড়চোখে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে।

বোধনদের বাড়িতে গতকাল সরস্বতী পূজা হয়ে গেছে। এবারই প্রথম প্রতিমা এনে বাসায় পূজা করা। সাজানোর জন্য বাসায় কিছু নেই। খুঁজে পাওয়া গেল কিছু সাদা কাগজ। আর একটা টেপ , তাও লাল রঙের। চৌকির পাশে চারটা বাঁশের টুকরা দড়ি দিয়ে আটকে দেয় চৌকির পায়ার সাথে। তারপর সাদা কাগজ লাল টেপ দিয়ে লাগিয়ে লাগিয়ে এক ধরণের নিজস্ব প্যাণ্ডেল বানিয়ে ফেলা। আর তার মধ্যে সরস্বতীকে চেপেচুপে বসানো। সাথে কিছু টুনি বালবের আলোকসজ্জা। বারো বছর বয়সের ছেলের একাকি করা এসব শিল্পকর্ম দেখে বোধনের মা খুব খুশি। বাবা কিছুটা রাগি, এসব দেখেও না দেখার ভান করে ছেলেকে বলে সবগুলো পাঠ্য বই সরস্বতীর কাছাকাছি রাখার জন্য। আজ দুপুরে সরস্বতী আর নেই। সকালবেলাতেই বাবা পাড়ার মন্দিরে মূর্তি রেখে এসেছে। জলচৌকি এই ফাঁকে সাদা লাল ক্যানভাসে একা হয়ে পড়ে।

বস্তির পারভীন বানুর আজ গায়ে জ্বর। সকালবেলা কাজে যেতে পারেনি। যে দুই বাড়িতে ঠিকা ঝির কাজ করে এক বাড়ির মহিলা খুব ভালো, অন্য বাড়ির বেটি মহা দজ্জাল। জ্বর সারিয়ে সেখানে যখন যাবে দজ্জাল মহিলা নিশ্চিত যে কয়দিন যায়নি তার বেতন কেটে রাখবে। সমানে মুখ চলে বেটির । আর কাজের ওপর কাজ। পরপর কয়েকদিন সেই বাড়িতে কাপড় ধুতে ধুতে জ্বর পাকিয়েছে পারভীন। পানির পিপাসা পায়। সেটা তীব্র হলে মেয়ে হালিমাকে ডাকে। কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় হালিমাকে ডাকার জন্য গলার স্বর আরো চড়ায়। হালিমার তাও কোনো খোঁজ নাই। পাশের বাড়ির আফরোজা উঁকি দেয়। এক গ্লাস পানিও দিয়ে যায় পারভীন বানুকে।

তপু এই দুপুরেই ঘুম থেকে উঠে। এই সময়ে মা অফিসে। আবার বাবা দীর্ঘদিন একঘেঁয়েভাবে মৃত। টেবিলে খাবার ঢাকনা দেয়া। ব্রেকফাস্ট তার কখনোই করা হয়ে ওঠে না। মা আগে ব্রেকফাস্ট আর দুপুরের খাবার আলাদা করে রেখে যেত। এখন আর করে না। খাবারটা ওভেনে দিয়ে তপু অ্যাকুরিয়ামের গোল্ডফিশ ও অন্যান্যদের একটু ব্যায়াম করায়। যেদিকে মাছগুলো থাকে সেদিকে আঙুল দিলেই অন্যদিকে সরে যায়। গোল্ডফিশগুলো যদিও একটু আলসে। মা ‘কম খাবার দেয়া’ থিয়োরিতে এই যাত্রা মাছগুলোকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রেখেছে। ছোট বনসাঁই কাছিম দুটো একটা কাচের জারে। এই জারের পানি পরিষ্কারের দায়িত্ব তপুর। দায়িত্বের কাজ বরাবরই অবিশ্বস্ততার সাথে করার ব্যতিক্রম এখানেও হয় না। কাচের জারের ঘন কালো ময়লার মধ্যে কাছিম দুটোকে দেখাই যাচ্ছে না। বাথরুমে নিয়ে কমোডে পানিটা ঢালতে গিয়েই টুপ করে একটা শব্দ হয়।

পাড়ার মাঠ দুপুরে একা একা থাকে। অনেক পুরানো জালবিহীন গোলপোস্ট গোলশূন্যতায় বিশ্রাম নেয়। বৃক্ষদের বেশি কাজ নেই। কোনো তাগিদ ছাড়াই কার্বন-ডাই-অক্সাইড হজম করে এরা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অক্সিজেন বিলোয়। ইটের ভাটার কাছাকাছি একটা মোটরগাড়ি এইমাত্র একটা বিড়ালকে চাপা দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যায়।