টুকুনগল্প

সম্পাদ্য

রাখাল অন্যান্য দিনের মতোই অশ্বত্থ গাছ থেকে কিছুটা দূরে একটু ছায়া একটু আলো জায়গাটাতে তার দোকানদারি শুরু করে। ছালা থেকে কাছিমগুলোকে বের করে উলটো করে রেখে দেয় কালো পলিথিন শিটটার ওপর। দা, ছুরিগুলোকে ধোয়ার জন্য বাজারের কোনায় আকবরের চায়ের দোকানের সামনের টিউব ওয়েলের দিকে রওনা দিলে কাছিমগুলোর ফুরসৎ মেলে। গলা বাড়িয়ে উলটো পৃথিবী দেখতে গিয়ে ঘাসের ডগায় দৃষ্টি আটকে গিয়ে তাদের পৃথিবী কিছুটা অস্পষ্ট হয়। গ্রামের পিচ্চিরা বাজারে ঘোরার সময় কাছিমওয়ালার অনুপস্থিতির সুযোগ নেয়। গাছের ডাল জোগাড় করে কাছিমগুলোকে খোঁচানো শুরু করতেই তারা একযোগে গর্তে মাথা লুকায়। পিচ্চিরা তাও গাছের ডাল দিয়ে গর্তের মধ্যে মাথা খুঁজতে থাকে। কিছু কবুতরের বাক বাকুমের উৎস খুঁজতে গিয়ে তারা দেখতে পায় কাছিমওয়ালা দা, ছুরি নিয়ে ফিরে আসছে। খোঁচানো বন্ধ করে তারা কিছুটা দূরে সরে কাছিমদের দেখতে থাকে। দা, ছুরিগুলোকে কাটার টুলের ওপর রেখে রাখাল কি যেন বিড়বিড় করে। একজন কাস্টমার হাজির হয়। একটা কাছিম দেখে শুনে পছন্দ করে। ‘কোনো কেজি মাপামাপি নাই। নিলে একটা কাছিম পুরা নিতে হইবো। এইটার দাম পড়বো চারশো।’ ক্রেতা তিনশো বললে রাখাল কাছিমকে পলিথিনের শিটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে। ক্রেতা সাড়ে তিনশো বললে রাখাল সেই কাছিমকে ধরে এনে সোজা করে রাখে কাটার টুলে। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিচ্চিদেরকে আশ্রাব্য গালাগালি করে দূরে সরায়। আশেপাশে তাদের আর দেখা না গেলে কাছিম কাটার প্রস্তুতি নেয়। সোজা পৃথিবী দেখার লোভে কাছিম অল্প অল্প করে মাথা বের করে একসময় মুগ্ধ হয়ে পুরো বের করতে যেতেই রাখালের নিঁখুত কোপে সেটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। অন্যান্য কাছিমগুলো আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় একদমই ভাবিত না হয়ে বরং ঘাস পেরিয়ে উলটো পৃথিবী দেখতে বেশি মনোযোগী হয়। আরো ক্রেতা হাজির হলে আস্তে আস্তে পলিথিনের ওপর থাকা কাছিমের সংখ্যা কমে যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসলে রাখালের খুব খিদে পায়। দোকানদারি বন্ধ করার প্রস্তুতি নেয়। একটা কাছিম তখনো উলটে পড়ে আছে। সেটাকে ছালায় ঢোকানোর আগে কেমন জানি কিম্ভূতদর্শন মনে হয়।

আকবরের দোকানে এসে এক-কাপ চা আর টোস্টের অর্ডার দেয় রাখাল। সাদা-কালো টিভিতে লাদেনের মৃত্যু সংবাদ গ্রামের লোকদের টিভির দিকে আগ্রহী করে তোলে। কিছু কিছু কথাবার্তা শোনা যায়। কেউ কেউ আমেরিকাকে গালাগালি করে। কেউ কেউ আশ্বস্ত হয়। কেউ কেউ ইন্নাল্লিল্লাহ ... বলে। রাখালের মতো কেউ কেউ লাদেনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। গানের টেপ চালানোর কথা একজনের মুখ থেকে বেরোলে রাজনীতিসচেতনদের ঝাড়ির মুখে সেটা চুপসে যায়। রাখাল বরং টোস্ট ভিজিয়ে যত্ন করে চা খায়।

বাড়ি ফেরার পথে চাঁদের অভাবে আকাশ পুরো অন্ধকার থাকে। কাছিমটা ছালার মধ্যে নড়াচড়া করে নিজের উপস্থিতির ব্যাপারে রাখালকে সজাগ রাখে। এই গ্রামের ইলেক্ট্রিসিটি রাস্তা আলো করে না। কিছু কিছু ঘর বা পাড়া পেরোলে রাস্তার একঘেঁয়েমি একটু কমে। পরে আবার শুরু হয়। বাড়িতে ঢুকেই রান্নাঘরে গিয়ে হাঁড়িতে ভাত বসায়। ছালা থেকে কাছিমটাকে বের করে মাটিতে রাখে। এবং উলটে। এইবার সে চেষ্টা করে পা দিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে সোজা হতে। বাড়ির উঠানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাত সিদ্ধ হবার অপেক্ষা করে। একবার আকাশের দিকে চোখ পড়ে। বাড়ির কাছে থাকা গাছগুলো অন্ধকারে গুঁটিসুঁটি মেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক শোনা যায়। পাশে রজবদের বাড়ির মাদি কুকুরটা বসে থেকে রাখালের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। রাখালও কাজ না পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ভাত ফুটে গেলে প্লেটে ঢেলে সেখান থেকে আলু সিদ্ধ দুটো আলাদা করে। খোসা ছাড়িয়ে কাঁচা মরিচ, সর্ষে দিয়ে সেটাকে ভালমতো ডলে। তারপর ভাতের সাথে মাখায়। কাছিম তখনো তার শারীরিক কসরতে সোজা হওয়ার চেষ্টা করে। ভাত খাওয়া শেষে একটা গামলায় পানি ঢেলে সেখানে কাছিমটাকে ছুঁড়ে দেয়। এই অযত্নে কাছিমের কোনো কষ্ট হয় না। বরং পানির মধ্যে গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে পরিবেশটাকে আপন করে নিতে চায়। কিছু ভাত সেই পানিতে ছুঁড়ে মেরে রাখাল উঠোনো গিয়ে বিড়ি ধরায়। রজবদের বাড়ির মাদি কুকুরের চোখের দিকে সরাসরি গভীর মনোযোগে তাকিয়ে থাকে।

রাতে গ্রাম একটা অস্পষ্ট নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়। শুয়ে থাকতে থাকতে রাখাল একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে চা খাওয়ার জন্য আলাদিনের চায়ের দোকানে যায়। মালাই চা অর্ডার দিয়ে বেঞ্চে বসে থাকে। মন্টুবাবুর মাথা নষ্ট আজ প্রায় বছর খানেক। আলাদিনের চায়ের দোকানের একপাশে বসে থেকে সে প্রাতঃকালীন গ্রামীণ সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। গ্রামের চেয়ারম্যান কুত্তার বাচ্চা এবারো গম মাইরা দিসে এক টনের মতো। রজবের বউ পরশু রাইতে ঢাকায় দারোয়ানি করার আক্কাসের লগে ভাগছে। রজবের কুত্তাটা সেই দুঃখে খালি মাইনষের চোখের দিকে তাকায়া থাকে। রজব এখনো খুলনা থন বাড়ী আয়ে নাই। সে অহনতরি কিছু জানে না। গ্রামের হেডমাস্টর পোলাপাইনগো এখন বাড়ি আইনা কোচিং পড়ায়। স্কুলে কিছু পড়ায় না। আমিনের ছোডো পোলাডারে শিয়ালে টাইনা নিছে গতকাইল। একটা টিয়া আর একটা শালিক এইবার ফাল্গুনে বিয়া করবো বলে ঠিক করছে। রজবগো মাদি কুকুর আমারে বলছে, সে মর্দা হইতে যায়। বেঞ্চিতে বসে থাকা লোকজন মন্টুবাবুর এসব খবরে দাঁত বের করে হাসে। মালাই চা হাতে আসলে মন্টুবাবুর কথাগুলো রাখালের কানে আর ঠিকমতো যায় না।

দুপুরের ঠিক আগেই গিয়ে হাজির হয় মণ্ডলদের ‘কাছিম প্রজনন কেন্দ্রে’। গোটা ছয়েক কাছিম কিনে বাড়ি ফিরে। পানিতে থাকা কাছিমটাকে ছালার মধ্যে থাকা অন্যান্য কাছিমগুলোর মধ্যে পাচার করে। পরে উঠোনে বসে বিকাল হবার অপেক্ষা করে। রজবদের মাদি কুকুরের দিকে তাকিয়ে তার মর্দা হবার খায়েশ বোঝার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। বিকাল তার নিজস্ব সময়ে হাজির হয়। রাখাল আবারো দোকানদারি করার জন্য রাস্তা ধরে।

একই নিয়মে অশ্বত্থ গাছকে একটু দূরে রেখে দোকানদারি শুরু করে। রাখালের কিছুক্ষণের অনুপস্থিতিতে গ্রামের পিচ্চিরা ঠিকই হাজির হয়, পরে দূরে সরে। রাখালের গালাগালিতে এক সময় আরো দূরে সরে গিয়ে কাছিম কাটার দৃশ্য দেখতে না পেরে রাখালকে গাল দিতে থাকে। সেইদিনও কিম্ভূত সেই কাছিম আবারো রাখালের সাথে বাড়ি ফিরে।

রাখালের কাছে থেকে যাওয়া কোনো একটি কাছিমকে রাখাল একটা নির্দিষ্ট কাছিম বলে মনে করতে থাকে। বাজারে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একটা কোনো কাছিম একটা বাড়তি দিনের বেশি পরমায়ু পায় না। বেশ অনেকদিন পেরিয়ে গেলেও রাখাল সেই একটা কাছিম আর বিক্রি করতে পারে না বলে আফসোস করে। এক রাতে বাড়ি ফেরার পথে সে কাছিমের সাথে কথা বলতে শুরু করে। কাছিমের নিঃসঙ্গতা রাখালের নিঃসঙ্গতার সাথে কাটাকাছি খেলে। রাখালের এইসব একান্ত ব্যক্তিগত গোলযোগ মন্টুবাবু কিভাবে যেন জেনে ফেলে। পরবর্তী দিনের গ্রামীণ সংবাদে মন্টুবাবু সেটা ঘোষণা করামাত্র বেঞ্চিতে বসে থাকা সব কটা চোখ রাখালের দিকে ফিরে। মালাই চা হাতে আসায় রাখাল মন্টুবাবুর সংবাদ কানে নেবার প্রয়োজন মনে করে না। এরপর আরো কিছুদিন পার হয়। এক রাতে রাখাল প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেই কাছিমটাকে ছেড়ে দেয় গ্রামের পুকুরে। পরদিন ভোরে রাখাল কাছিমের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আলাদিনের চায়ের দোকানে পৌঁছায়। গ্রামের পিচ্চিরা কাছিমের অভাবে গাছের ডাল দিয়ে সদ্য কাছিম হয়ে পড়া রাখালকে খোঁচানো শুরু করে।