আমরা লেখকসংঘের লোক। আমাদের নিয়ে কেউ তাফালিং করলে আমরা তাদের একত্রে সাইজ করি। সাকুল্যে আমরা আটজন। উঠি বসি খাই একসাথে। আর এক দুটা জৈবিক কাজ আলাদা আলাদা করি। স্বাভাবিক কারণে আমরা ছয়জন আলাদা আলাদা শুই। আমাদের স্ত্রীরাও সংখ্যায় ছয়। অরিন্দম আবির একসাথে শুতে যায়। এই নিয়ে আমাদের মাঝে মাঝে হাসি তামাশা হয়। মাগার অন্য কেউ কিছু বলতে গেলে আমরা একজোটে ঠেকাই। আমরা বেশ ভালো লিখি। একজনের লেখা কোথাও ছাপা হলে বাকীরা তার শিল্প আঙ্গিক নিয়ে চুলচেরা করি। প্রধান দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের সাথে আমাদের বিস্তর ওঠাবসা। নানান সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, সাংস্কৃতিক ভাব জগৎ নিয়ে আমরা শীর্ষ কলামগুলো লিখি। আমাদের পাঠক আমাদের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন। দেশপিতার যাবতীয় কর্ম কাম আমাদের লেখনীতে অঙ্কুরিত হয়, আহা, অপরূপ মাধুরী দিয়ে।
রাজ্যপিতার ভোজসভায় আমরা প্রতি শুক্রবার আমন্ত্রিত হই।থমাস আলম আবির আমাদের এই তিনজন ভোজনরসিক। ওদুদের ডায়াবেটিস, একদম মেপে খায়। বাকীরা মাঝাহারী। আলম সায়ীদ আমাদের কবি। দুজনের লেখা নতুন তুমুল এক দুটা কবিতা আমরা বৃন্দ আবৃত্তি করি। কাব্যপাঠ শেষে রাজ্যপিতা কাগজের খাম দেন। বাইরে এসে আমরা গুনে নিই কতো আসলো কবিতা পাঠ থেকে। একবার রাজ্যপিতার চেলাদের খুনোখুনিকে আলম অসাধারণ এক পদ্য লিখে জায়েজ করে দিয়েছিল। বাইরে এসে খামে দেখি দশ লাখ টাকার চেক।
লোক আড়ালে আমদের অষ্টবক্র কয়। শিমুল আমাদের নাট্যকার। ঔপন্যাসিক হলাম ওদুদ রিফাত অরিন্দম। রিফাত এবারের বইমেলায় অষ্টবক্র নামে এক উপন্যাস ছেড়েছিল। পুরো বইমেলার বেস্টসেলার। পরের সাতটি ছিল আমাদের সাতজনের বই। আসামী ছদ্মনামে এক লেখকের বই চলছিল প্রথম কয়দিন খুব। পরে আমরা মিলে সিস্টেম করে ফেললাম। বইটা ছিল উপন্যাস টাইপ। আমরা সবাই মিলে একটা লাইন চিহ্নিত করলাম সেই বই থেকে। আমিন তার আবাল বাপের কথায় থুথু ছিটায়। রাষ্ট্রপিতার সেন্সরবোর্ডকে দেখাই লেখকের আগডুম বাগডুম। আসামীকে সত্যি আসামী করা হয়। আর বই হয় বাজেয়াপ্ত। ওই ব্যাটাকে জেলে ঢুকানোর রাতে মনিকা চৌধুরীর বাড়ি যাই আমরা ছয়জন। আবির-অরিন্দম নিজেদের দোকা করে। ওরা দুজনে মনিকার ছায়াও মাড়াতে চায় না।
থমাস আমাদের চেকভ। ছোট করে সব লিখে।বিস্তর ওজনদার লেখা। আমরা মোহিত হই। গল্প ছোট কিন্তু শিরোনাম ম্যালা লম্বা। এবার সাহিত্য পুরস্কার পেল থমাসের গল্পগ্রন্থ। নাম কাকতারকালোপাখায়সাদাইয়েলাগিয়েআকাশেইতস্ততবিচরণশেষেমল্লিকাদিরজানালায়ফুচিমারে। পুরষ্কার বিতরণীতে থমাসের নাম ঘোষণার পর আমরা আটজন একসাথে স্টেজে উঠেছিলাম। দর্শকরা একটু হেসে উঠেছিল। আমরা একটু কেশে উঠেছিলাম।
আবির আমাদের মধ্যে সবজান্তা শমসের। কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস আরো ছাতানাতা অনেক কিছু লিখে চলে। আমাদের মধ্যে সবচে মিতভাষী কিন্তু সবচে বেশি লিখে। এই পর্যন্ত প্রকাশিত বই সংখ্যা নয়শো তের। এক হাজার পুরালে ওইদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা হবে। রাজ্যপিতা এক ভোজসভায় জানিয়েছেন। আমরা বাকিরা ওকে বাংলার ক্যারোল ওটস বলে খেপাই। তখন মিটিমিটি হাসে।
গতকাল মাইক্রো করে যাচ্ছিলাম সবাই। একটা সেমিনারে। রিফাতের মোবাইলে রাষ্ট্রপ্রধানের ফোন এলো। রিফাত স্পিকারে দিয়ে দিলো যাতে সবাই শুনতে পারি। তিনি বললেন লেখকসংঘকে দেশব্যাপী চালু করে দেয়ার জন্য। আটজন দশজন কি বিশজনের দল নিয়ে একেকটা আঞ্চলিক লেখকসংঘ গড়ে উঠবে। প্রত্যেক লেখক কোন না কোন ব্যানারের তলে থাকবেন। একা কেউ থাকতে চাইলে তাকে লেখক বলা যাবে না। এটা নিয়ে সংসদে সংশোধনী পাস হবে আজ। আর সার্বিক দেখভাল করতে হবে আমদের আটজনকে। শোনার পর আমরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে পড়ি। ক্ষমতা! আহা! আমাদের আর শত্রুপক্ষ থাকার সুযোগ থাকবে না। আমরা প্ল্যান করি প্রথমে যাবো চট্টগ্রামে। আগ্রাবাদ হোটেলে বেশ মাস্তি করা যায়। গিয়েই চার পাঁচ দিনের মধ্যে একটা সংঘ খাড়া করে ফেলবো। বলা হবে, নতুন সংবিধান অনুসারে সংঘের ছাদনাতলায় যে নাই সে লেখক না। সুতরাং অলেখকদের বই কেউ ছাপাতে পারবে না। এই সম্ভাব্য ভাবনায় আমরা এতো উদ্বেলিত হই , সেমিনারে গিয়ে যা ইচ্ছা বাকবাকুম করে আসি। শিমুল কয়- নাটক মানেই ঘাস নদী ফুল আর যৌবন। ওদুদ বলে- এরাম সেরাম লিখলেই ঔপন্যাসিক, এটা বলা যাবে না। মাল থাকতে হবে, যা আমাদের আছে। আবির বলে- ব। সায়ীদ কয়- এইবারে এইবারে ক্ষান্তিব ওগো তোমার শিরস্ত্রাণে। অরিন্দম কয়ে উঠে- উপন্যাস সাহিত্যের পিতৃস্বরূপ। থমাস বলে- আমাদের ছোটগল্প সুমনাবাসনারটানেছিন্নবস্ত্রেঘরছেড়েগোকুলেযায় আপনারা নিশ্চয় পড়েছেন। রিফাত কয়- অষ্টবক্র বেষ্টসেলার করেছেন, আমরা তাই খুশি। আলম বলে – সায়ীদ যে লাইনটা পড়ে শোনালো ওটা আমাদের দুজনের লেখা। ফেরার সময় গাড়িতে দেখি সেমিনারের বিষয় ছিল- ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের লেখায় লাঁকা-দর্শন।
চার-পাঁচ মাসের মধ্যে আঞ্চলিক লেখকসংঘগুলো আমরা দাঁড় করিয়ে ফেলি। শক্তিশালী কারো লেখার হাত পেলে তাকে অলেখক বানানোর কাজটা বেশ ভালো করে সমাধা করি। দেশজুড়ে অলেখকদের নিয়ে সংঘ বানিয়ে অবশেষে আমরা রাজধানীতে ফিরি। ব্যাগ বয়ে আনা টাকার স্তুপ ব্যাংকে জমা দিয়ে যার যার বাসায় ফিরি।
এভাবে দিন কেটে যায়। রাষ্ট্রআব্বার বিভিন্ন দাওয়াতে, হরেক সেমিনারে, পুরষ্কার বিতরণীতে, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, সম্পাদকদের উপবৃত্তটেবিলে, মানববন্ধনে, পিঠাপুলি উৎসবে সময় দিতে গিয়ে আমাদের সময় কেটে যায়। তবে মনিকা চৌধুরীর বাড়ি যাই নি সে অনেক দিন।
কোনো এক সচলায়তন সঙ্কলনে প্রকাশিত।