টুকুনগল্প

সবুজ বনসাই হাতি

আমাদের পুরানো বাড়ি, তার চারপাশে টানা চিকন বারান্দা। পাশের বিল্ডিংগুলো খুব গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকায় আমাদের বাড়িতে কোনো গ্রিল নেই। বারান্দায় থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগারটাকে একবেলা করে খেতে দেয়া হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। খেতে বসে মা কথাটা জানায়। দুপুরে যে তাকে খাবার দেয়া হয় না খেয়াল পর্যন্ত করিনি। বেশ কয়েক টুকরা রান্না করা মাংস আর এক বাটি ভাত নিয়ে বারান্দায় এসে টাইগারকে ডাকি। তার বদলে দেখতে পাই একটা অতিকায় গিরগিটি আটকে আছে পাশের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির দেয়াল দুটোর মাঝে। গিরগিটির চোখে আকুতি। আমি আবারো টাইগারকে ডাকি। বারান্দা ঘুরে ঘুরে টাইগারকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু পাই না।

বড়দা জানায় তার সবুজ বনসাই হাতিটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না বেশ কয়েকদিন। বেচারা খুব ছোটো হয়ে পড়ায় বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মরে যাওয়া কোনোমতেই যে বেঁচে থাকার চেয়ে ভালো না- এই কথা বড়দা প্রায়ই বনসাই হাতিকে বোঝাতে চাইতো। হাতিটা এইসব কথা বিশেষ কোনো আগ্রহ নিয়ে শুনতো না। ভাগ্যিস ইচ্ছামৃত্যুর কথা হাতিদের সমাজে এখনো চালু হয়নি। আমি বড়দাকে বলি- বারান্দায় একটা গিরগিটি ঝুলে আছে। বড়দা তখন টাইগার নিখোঁজ হওয়া, হাতি হারানো, গিরগিটি ঝুলে থাকা সব মিলিয়ে একটা কোনো কনস্পির‌্যাসি থিয়োরির কথা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মা বাসন ধুতে থাকে। কল দিয়ে এক নাগাড়ে জল পড়ছে তো পড়ছেই। আর বাসনের টুংটাং।

আজ বিকেলে পাড়ায় মোরগ লড়াই। আমি তৈরি হয়ে বড়দাকে ডাকি। বড়দা যেতে চায় না, বরং একা একা কনস্পির‌্যাসি থিয়োরি বকবক করে বলে যেতে থাকে। সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেক দেরি। কিন্তু আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাওয়ায় বেশ অন্ধকার। আমি টেলিফোন বুথের দিকে দৌড় দেই। মেঘ-কাটারের নম্বর বুথের লিস্টে আছে। ফোন করে জানাই- আজ পাড়ায় মোরগ লড়াই। অনেক দর্শক আসবে। বৃষ্টি নামলে সব মজা শেষ। মেঘগুলোকে ছাঁটতে হবে। মাঠে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে দেখি মেঘ-কাটার তার বড়ো বড়ো কাঁচি দিয়ে কালো কালো মেঘগুলোকে ছেঁটে দিচ্ছে। সূর্য শেষ বিকেলের আলো ছাড়ে। মোরগ দুটো লড়াই করতে থাকে। একজন আরেকজনকে রক্তাক্ত করে ফেলে। আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি।

আমাদের ধর্মে পাখি খাওয়া হারাম। তবে মারা হারাম নয়। আমাদের পাড়ায় পাখি মারার শটগান বেচে আবু শেখ। আবু শেখ রাজাকার। আমাদের পাড়ার শ'খানেক মুক্তিযোদ্ধাকে আবু শেখ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল। আবু শেখ মুক্তিযোদ্ধা সায়ীদের বোনকে একাত্তরের জুলাই মাসে তুলে নেয়। আর্মির হাতে তুলে না দিয়ে জোর করে বিয়ে করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা মারতে মারতে আবু শেখকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। বোনের অনুরোধে সায়ীদ গিয়ে শেখকে বাঁচায়। আবু শেখ আস্তে ধীরে ব্যবসা বাণিজ্য করে পয়সা বানায়। জীবন বাঁচানোর উপহার হিসেবে সায়ীদকে মিথ্যামিথ্যি একটা হত্যাকাণ্ডের আসামী করে। ফাঁসিও হয়। আবু শেখ এখন আমাদের পাড়ায় ওয়ার্ড কমিশনার। তার গল্পগুলো আমরা পাড়ার লোকেরাই কেবল জানি। তবে এগুলো শুনে আবু শেখের ব্যাপারে আমাদের বেশির ভা্গের খুব একটা কিছু হয় না। তাকে সময়ের শিকার বলে মনে হয়। আবু শেখের নির্যাতন লাম্পট্য বিশ্বাসঘাতকতা দেখেও তাকে মানুষ ভেবে নিতে হয়। একটা কথা নানা জায়গায় শুনতাম। সব ঘৃণা রক্তগঙ্গায় ধুয়ে মুছে গেছে। আসুন, সব ভুলে নতুন করে সবকিছু শুরু করি। নিজে একটু অটিস্টিক বলে আবু শেখকে আমার খুব ঘৃণা হয়। আমার ইচ্ছা করে ওর দোকান থেকে কেনা শটগান দিয়ে ওর প্রতিটা লোমকূপ বরাবর গুলি ছুঁড়ি। এসব ভাবতে ভাবতে চলে আসি এক-দুই-তিন ক্লাবে। তাস খেলতে। আবু শেখের ব্যাপারে আমার ইচ্ছার কথা খেলতে খেলতে বন্ধুদের জানাই। রিপনও অটিস্টিক বলে আমার কথাতে খুব উৎসাহিত হয়। বাকিরা বলে- আবালের মতো কথা বলা বাদ্দে। আবু শেখরে তুই চিনোস্। সায়ীদ ভাইরে কি করছে জানোছ না। ওদের কথাবার্তা আমার পছন্দ হয় না। আমি কার্ড দিতে ভুল করি। খেলায় হেরে যাই।

রিপনের সাথে বাড়ি ফেরার পথে আলাপ করি। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে আসবে আবু শেখ। আমদের দুইজনের দুইটা শটগান ওর উপরে টার্গেট করবো বলে ঠিক করি। বাসায় ফিরে দেখি টাইগার বারান্দায় বসে হাই তুলছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাই তুলে। বড়দার ঘরে সবুজ বনসাই হাতি তার হাতের তালুতে। বারান্দায় যাই। সেখানে গিরগিটিটার ছিন্নভিন্ন দেহ। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে দেয়াল বেয়ে।