টুকুনগল্প

আমি উঠে গিয়ে মেঘ সরিয়ে দিই

সকালে উইঠ্যায় মেজাজ বিগরায়ে গ্যাছে। বুয়া বেটি আইজো আসে নাই। এহন নিজেরই চা বানায় খাওন লাগবো। চট্টগ্রামের লালখানবাজারের এই চিপায় পইরা জীবন এক্কেরে শ্যাষ। ট্রিপল মার্ডারটা বসের কথায় করা লাগছিল। রুম্মান ও লগে ছিল। ওই হালায় তো ঢাকায় মাস্তি করতাছে। দোষ যে কেমনে আমার ঘাড়ে পড়লো হেডা মালুমের আগেই তো এই চিপার মধ্যে বস হান্দায় দিলো। হালকা দাঁড়ি গজাইলাম। ডেগার শরীফ সাজলাম হালায় এক মালাউন, রনি সাহা। আর এই পাড়ায় , কি আর কমু, ম্যালা মালু। সন্ধ্যা নামলেই কাঁসা, ঘণ্টা, উলু লইয়্যা ঝাঁপাইয়া পড়ে।এই পাড়া কন্ট্রোল করে টক্কর সিরাজ।ওরে দেখলেই চান্দি গরম হইয়্যা পড়ে। কেরমে জানি কথা কয়। ঝামেলা মিটলে ঢাকায় যাওনের আগে ওরে ফালায়া যামু।

এহানে বাসা বাড়ির মধ্যে প্রাইভেসি নাইকা। ঢাকার তন খারাপ, একটা বাড়ি আরেকটার লগে লগে উইঠ্যা গেছে। আমার লাগোয়া ঘরে এক মালু থাকে। তার এক মাইয়্যা আছে। কেলাস টেনে পড়ে। হের বাপে মাঝে মাঝে আমার এহানে ঢোকে কথা কওনের লাইগ্যা। ‘যে’ ‘যে’ কইয়্যা মাথা খারাপ কইরা ফ্যালে। আপন কি করতেছিলেন যে? আরে না, আপনার এইভাবে ভাবার দরকার নাই যে। খাঁটি চাটগাঁইয়াগো শুদ্ধ ভাষা কওনের চেষ্টা জটিল ফানি। বাপটারে খেদাই না কারণ মাইয়াটারে ভালা লাগে। একদিন কি একটা রাইন্ধা হের মা পাঠাইছিল। আমি হাত ধইরা উমারে সোফায় বসাইছিলাম। কাইপ্যা উঠছিল।

চিটাগাংয়ের রাস্তাঘাট চিপা। তয় পয় পরিষ্কার। ঢাকার লাহান ডাস্টবিন হইয়্যা যাই নাই। এগো তো আবার নিজেগো ভাষা। পরথম পরথম বুঝতাম না। অহন সব কথাই বুঝি। ঝগড়া লাগলেই ‘চোদানীর পোয়া’ গাইলটা পাড়ে একজন আরেকজনরে। আমার মজাই লাগে । মাঝে মাঝে বস ফোন দ্যায়। উনারে ফোন দেওন নিষেধ । কাইল কইলো, আরো মাস দুই মাস এহানে ঘাপটি মাইরা থাকন লাগবো। মাঝে মাঝে পুরা পৃথিবীটারে ঠাপ দিবার ইচ্ছা লাগে। বসরে পুংগা মারবার ভীষণ মন চায়। অইদিন বুঝলাম এহানের হালারা আমারে আড়ালে বইঙ্গা রইন্যা নাম দিছে। সব হারামীর ছাও। দাও গিয়া। রইন্যা আমার আসল নাম না।

রিয়াজুদ্দিন বাজার এলাকাটা ঢাকার গুলিস্তানের লাহান। পরশু ঘুরতাছিলাম ওই জায়গায়। অপর্ণাচরণ স্কুলের সামনে গিয়া একটা সিগারেট ধরাইলাম। পিলপিল কইরা মাইয়া বারাইতেছিল। কতক্ষণ দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখলাম অগো। তারপর ন্যুমার্কেটে ঢুইক্যা ফালুদা খাইলাম। কি জানি নাম দোকানটার। উমা কইছিল, ওইটার নাকি ফালুদা ভালা। দ্বিতীয় তলায় গেলে একটাই আইসক্রীমের দোকান। যে।

আমার বাপে সরকারি চাকরি করতো। এক বছর আমরা চিটাগাং আছিলাম। আসকারদীঘির পাড়ে বাসা ছিল আমাগো। আমি কোন ক্লাসে পড়তাম তহন? সিক্সে নাকি সেভেনে? পরের বছর বাপের অয় ঢাকায় পোস্টিং। আমরাও ঢাকায় চইল্যা যাই। বাপে মারা গ্যাছে তার এক বছর বাদ। মার মাথাটা সেই যে আওলাইছে অহনতরি ঠিক অয় নাই। মারে বড় খালা দ্যাখে। মাসে মাসে টাকা পাঠাই, মধ্যে মধ্যে খালারে ফোন দেই। আমার এক বড় বইন আছে , বাপের আগের ঘরে। আম্রিকা থাকে নাকি। হের লগে জীবনে দেহাও অয় নাই। যাউগ্‌গা।

আমিনবাজারের চিপায় বাপে ঢাকায় বাসা লইছিল।মাঝে মাঝে মনে লয় বাপে হালায় অইখানে বাসা না লইলে আমি অয়তো ডেগার শরীফ হইবার পারতাম না। জায়গাটা ডাইল গাঞ্জার এক্কেরে সদরঘাট। বাপের মরণের পর কেমনে যে এই লাইনে আইয়া পড়লাম অহন ঠিকমতো মাথায় আহে না। রইছের লগে পরথম এই লাইনে আইছিলাম। পরে এক ক্যাঁচালে ওরে ও ফালায় দেয়া লাগছিল। ছুরি ঢুকানোর সময় অর চৌকে চৌক পড়ছিল। মাঝেমইধ্যে ঘুমের মইধ্যে অর চৌক দেহি। আমাগো লাইনে সিস্টেমই এইটা। আম্রিকান সিস্টেম। কামের সময় তোমারে চুমাইবো, কাম ফুরাইলে লাত্থি। আমারেও যে কেউ সাইজ কইরা ফেলতে পারে। আমি কাউরে বিশ্বাস করি না। মাথাটা ক্লিয়ার রাখি, আর চৌককান খুলা রাখি। তিন চাইর বছর আগে আমি একবার বিস্তর ভয় খাইছিলাম। অহন আর ভয় খাই না।

বইস্যা থাকতে থাকতে মাথায় চিনচিনা ব্যথা করে। বাথরুমে গিয়া ঘাড়ে মুখে পানি দেই। মনে লয় ছোট্ট ফোঁটার মতো কোন সূচ সূচ ব্যথা। একবার অই ব্যথা ভেতর থন বাইরে যায়, আবার ভিতরে ঘাপটি মাইরা ঢুকে। আর এক মুসিবত এখানে। গরমে টেকা যায় না। তার উপরে কারেন্ট এই যায়, ওই আসে। পানি থাহে না। উমার বাপে ঘরে টোকা দেয়। গরম যা পড়তেছে যে। বেটারে ইচ্ছে লাগে মনের সুখে চাবকাই। ঘরে ঢুইক্যা নানান কথা কয়। আমি উ আ করি। ওর মতলবটা কি? উমারে কি আমার ঘাড়ে গছাইবার চায়? যদি হে জানতো আমি বিশ বাইশটা মার্ডার করছি আর মোসলমানের পোলা তখন হালায় উস্‌টা খাইতে খাইতে মরতো। কারেন্ট আয়া পড়লে হে উইঠা চইলা যায়।

চিপা একটা বারান্দা আছে বাসাটায়। রাইতে আবার কারেন্ট যায়। শোয়ার থন উইঠ্যা চুপচাপ ওইখানে খাড়াইয়া বিড়ি টানি। পুরা মহল্লা থেকে নানান শব্দ মিলায়া এক অদ্ভুত জোড়াতালি আওয়াজ কানে লাগে।বাচ্চাগো পড়ার বিড়বিড়া আওয়াজ, নিচের দোকানদারের কি নিয়া ক্যাঁচাল, এই অদ্ভুত সময়ে হারমোনিয়াম নিয়া কার জানি ক্যাওম্যাও, মদখোর হাজারীলালের গরগর গলায় শোর ‘চোদানীর পোয়া, তরার ব্যাকগুনরে আঁই…’, দেয়ালে কে জানি বাড়ি মারে গদাম গদাম, উপরতলায় চেয়ার টেবিল সরায় লোকজন, কারো রান্নাঘর থাইক্যা তেলে পিঁয়াজ ছাড়নের ছ্যাৎছ্যাৎ, মালুগো সন্ধ্যাবাতির টুংটাং, এক শালার এই রাতে মাছ মাছ কইরা চিল্লানি, ওই বাড়ির পাগলা বাসুর বাথরুমের গিয়া উড়াধুড়া ঘোৎঘাৎ, আর মনে লয় কে য্যান কান্দে? উমায় নিহি? ধুরু।


ফিরেঃ গল্পের শিরোনাম জয় গোস্বামীর আলো কবিতা থেকে।