মা কেন জানি বাসায় নতুন এক স্যার নিয়ে এসেছে। সব কিছুতে মার বেশি বেশি। মার একদম নতুন বাতিক। স্যারের সাথে বেশি হেসে কথা বলা যাবে না। এই ওই। এতো মেপে সব করা যায় নাকি? আর সব তো চ্যাংড়া চ্যাংড়া স্যার। বিশ্বজ্ঞানী ভাবে নিজেদের এক এক জন। আমার সবার সব কথায় হু হা করতে ভালো লাগে না। আগের স্যারটাকে খুব ভালো লাগতো। এমনিতে চুপচাপ থাকতেন, কিছু একটা নিয়ে বলতে গেলে তখন আর কথা থামাতেন না। প্রথম প্রথ...মা কেন জানি বাসায় নতুন এক স্যার নিয়ে এসেছে। সব কিছুতে মার বেশি বেশি। মার একদম নতুন বাতিক। স্যারের সাথে বেশি হেসে কথা বলা যাবে না। এই ওই। এতো মেপে সব করা যায় নাকি? আর সব তো চ্যাংড়া চ্যাংড়া স্যার। বিশ্বজ্ঞানী ভাবে নিজেদের এক এক জন। আমার সবার সব কথায় হু হা করতে ভালো লাগে না। আগের স্যারটাকে খুব ভালো লাগতো। এমনিতে চুপচাপ থাকতেন, কিছু একটা নিয়ে বলতে গেলে তখন আর কথা থামাতেন না। প্রথম প্রথম আমার দিকে সরাসরি তাকাতেন না। আমি একদিন বললাম- আপনি চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পান? তারপর থেকে উনার ভয় একটু কেটেছিল। আমার সাথে আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসছিলেন। উনার বাড়ির গল্প করতেন। কিন্তু মা কিছু একটা গন্ধ পেলেন।বলা নেই কওয়া নেই একদিন বেতন দিয়ে বলে দিলো – আপাততঃ ও কিছুদিন বাসায় পড়বে। আমার খুব কান্না পেয়েছিল সেদিন। আরো কয়েকটা বাসার স্যার মা বদলেছে। তখন কিন্তু এতো খারাপ লাগে নি।
মার আমি একটাই মেয়ে। আমার বাবার সাথে মার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি তখন খুব ছোট। বাবা কখনো আমাকে দেখতে ও আসেন নি পরে । বাবার চেহারা আমি মাঝে মাঝে আঁকি। মাঝে মাঝে গোঁফ দিই, মাঝে মধ্যে দিই না। মা একদিন আলমারিতে চাবি রেখে বাইরে কোথায় জানি গিয়েছিল। আলমারির অনেক জিনিষপত্র আমি ঘেঁটেছিলাম সেদিন । বাবার কোন ছবি পাই নি। হয়তো বাবার কোন স্মৃতি মা রাখে নি । কেন জানি মাকে কখনো ওভাবে জিজ্ঞেস ও করি নি বাবার কথা। আমি মাকে খুব ভয় পাই।কখনো একদম পাই না।
আমার নতুন বাবা আমাকে অনেক আদর করেন। প্রথম প্রথম বাবাকে ভালো লাগতো না। অনেকদিন বাবা বলে ডাকি ও নি। বাবা কিছু মনে করতেন না। মা একটু কড়াভাবে তাকাতো যখন আমি বলতাম উনাকে- বাইরে গেলে কলম নিয়ে এসেন বা এই জাতীয় কোন কিছু।আমার নতুন বাবার কিছু রিলেটিভ আমাদের বাসায় আসার পর মা আমার রুমে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে আমার বিছানায় বসলো । বললো- বাবু, আগে কখনো তোমায় বলিনি। এঁদের সামনে অন্ততঃ বাবাকে বাবা বলো। মা এমনভাবে বললো, তারপর থেকে আমি উনাকে বাবা বলি।
আমার স্কুলে কারো সাথে ভাল বন্ধুত্ব হলে কেন জানি সে স্কুল ছেড়ে চলে যায়। আমার সেজন্য ভালো করে কারো বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে নি। আমি নিজে নিজে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি। আর্টের ক্লাসে যাই।টিভিতে অনেক সিরিয়াল দেখি।ইদানীং সুডুকু খেলি। আমার নিজের সাথে নিজের সময় কাটাতে খারাপ লাগে না। স্কুলে গরমের ছুটির সময় মা যখন আমাকে একা রেখে চলে যেত, বাইরে যাবার সময় বলতো – একদম মন খারাপ করবে না। আমার কিন্তু মন কিছুতেই খারাপ হতো না। সময় কেটে যেত।
আমি খুব বেশি গল্পের বই পড়ি নি। হ্যারি পটার সবগুলো পড়া হয়েছে , আমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে একবার পেয়েছিলাম , চারটার সেট। বাসায় একটা পুরানো ঠাকুরমার ঝুলি আছে , আর কোন গল্পের বই নেই। বইটা আমি অনেক কয়বার পড়েছি। হ্যারি পটারের সাথে ঠাকুরমার ঝুলির অনেক মিল। আমি মাঝে মাঝে ভাবি এটা নিয়ে আমি বড় হলে একটা বই লিখবো।মাকে বলেছি – মা হাসে।
আমাদের বাসায় কোন ফোন নেই। মোবাইল আছে। বাবা মার দুজনের দুটা। আমি নিজের জন্য একবার চেয়েছিলাম। বাবার , আমার নতুন বাবার আপত্তি ছিল না। মা একদম না করলো। আমার একটু খারাপ লেগেছিল। পরে ঠিক হয়ে গেছে। চাচার বাসায় গেলে আমি নেট ব্যবহার করি। স্কুলে আমার সব বন্ধুদের ই-মেইল আছে। আমার নেই শুনলে হাসে। চাচাকে বলেছি। বলেছেন- এই সপ্তাহে করে দেবেন। স্কুলের কাউকে ফোন করতে চাইলে মার মোবাইল থেকে করি । মা বলে - সামনে কথা বলো। রাগ লাগে, তাও সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলি। মার সাথে কথা কাটাকাটি করতে আমার ভালো লাগে না।মাকে আমি কিছু বোঝাতে পারি না। উল্টো মা আমাকে যা বোঝায় আমি ঠিকঠাক বুঝে যাই।
আমার রুমের পাশে একটা বারান্দা আছে। রাতে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি অনেক ভয়ের ভয়ের স্বপ্ন দেখি। ঘুম ভাঙ্গলে স্বপ্নের কিছুই মনে পড়ে না। তবে কেমন খালি খালি লাগে। মাকে একবার বলেছিলাম আমার ভয়ের স্বপ্ন দেখার কথা । মা বলেছে ঠিক মতো হাত মুখ ধুয়ে রাতে বিছানায় শুতে যেতে।
বাসায় এক নতুন বাচ্চা মেয়ে এসেছে কাজ করতে। আগের মেয়েটা চলে গেছে। আগের মেয়েটা খুব গেছো ছিল। কাজের চে অকাজ করতো বেশি। আমি ওর সাথে খেলতাম কখনো কখনো । খুব মজার একটা বাংলায় কথা বলতো। বারান্দায় গিয়ে মাঝে মাঝে কাঁদতো। আমার তখন কষ্ট হতো। আমি কাঁদতে পারি না। মার মতো একদম। আমার নানার মৃত্যুর সময় দেখেছি। মা একদম শক্ত হয়ে ছিল ।কিন্তু কাঁদে নি। আচ্ছা, আমার মা মারা গেলে কি আমি ও মার মতো শক্ত হয়ে থাকবো?